আমি তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি। আমি এর আগে কখনো কোনো পরীক্ষাতে দ্বিতীয় হই নি। ক্লাশ ফোরে ওঠার পর থেকে পারিবারিক একের পর এক ঝামেলা ছিল। ছোট বোনের বয়স তখন ৭-৮ মাস, মা তাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত। বাবার ট্রান্সফার হয়েছে গফরগাঁওয়ে, আমরা থাকি নিজেদের বাড়ি টংগীতে। ট্রান্সফারের পর থেকেই আমরা গফরগাঁও যাই যাই করতে করতে আমি স্কুলেও ভর্তি হই নি। শেষমেষ স্কুলে ভর্তি হলাম প্রথম সাময়িক পরীক্ষার প্রথম দিন সকাল ৯টায়। তেমন কোনো বইপত্রও নেই, যা পারি পড়ে গিয়ে পরীক্ষা দিলাম, হলাম দ্বিতীয়। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাতেও একই ঘটনা, এবারো দ্বিতীয়। আমার মনও খারাপ হয় নি, আমি হতাশও হই নি – আমার চিন্তা ছিল প্রথম হতে হবে, সিম্পল। প্রথম হতে হলে কি করতে হবে? পারফেক্ট পরীক্ষা দিতে হবে ফাইনালে। দ্বিতীয় সাময়িকের ফল দিল সকাল ১০-১১টার দিকে। আমি বাড়ি ফিরে ওয়ার্ড বুক বইটা বের করে শুরু করলাম “পারফেক্ট” হওয়ার পড়া। লাইনের পর লাইন স্কেল রেখে রেখে পড়েছি। সিদ্ধান্ত ছিল একটা শব্দও মিস করবো না, একটা অক্ষরও না। ক্রিকেট খেলেছি, ফুটবল খেলেছি, খেলা দেখেছি, কিন্তু পড়ার সময় একটাই কথা ছিল, “এই পরীক্ষায় একটা অক্ষরও মিস করব না”। আমি জানতাম আমার যে বন্ধু গত দুই সাময়িকে প্রথম হয়েছে সে অসম্ভব ভাল ছাত্র, যে তৃতীয় সেও। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আছে ঐ স্কুলেই টানা ৯ পরীক্ষায় (৩ শ্রেণীর তিনটি করে পরীক্ষা) প্রথম হওয়ার। এই অভিজ্ঞতারও তো একটা দাম আছে! আমি নিশ্চিত ছিলাম দুই সাময়িকের ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রথম হতে হলে আমাকে পারফেক্ট পরীক্ষা দিতে হবে (বিশেষ করে প্রথম সাময়িকের ব্যবধানটা বেশ বড়ই ছিল)।
পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার আগে-পরে অনেক দোয়াদরুদ পড়েছি, সত্য কথা। কিন্তু মনের কাছে প্রশ্ন ছিল, “আমি প্রথম হবো কেন, কেন ও নয়?” উত্তর তৈরি ছিল, “আমি এই সাময়িকের সিলেবাসের সব পারি”। আমার জীবনের অন্যতম বড় অলৌকিক কান্ড ঘটে গেল, আমি দুই সাময়িকের ব্যবধান ঘুচিয়ে ২ মার্ক বেশি নিয়ে প্রথম হয়ে গেলাম 🙂 চতুর্থ শ্রেণীতে ব্যবধান তৈরি করা বেশ কঠিন। কিন্তু আমার আশা ছিল। কারণ? আমার কাছে উত্তর ছিল, “কেন আমি প্রথম হব?” প্রশ্নের। উত্তরটা ছিল, “কারণ আমি স্বাভাবিকের দ্বিগুণ পরিশ্রম করবো” 🙂
এবার চিন্তা করো ক্রিকেটের কথা। পৃথিবীর এতো এতো লোক এতো ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিকেট খেলে, টেন্ডুলকারের বা পন্টিং্যের এতো রান কেন? ক্লার্ক-কুক-আমলা-আশরাফুল এতো ভাল ক্রিকেট খেলে কিভাবে? টেন্ডুলকারের এলবো ইনজুরির কথা বেশ বিখ্যাত। তিনি সেবার বেশ কিছুদিন খেলার বাইরে ছিলেন। পত্রিকায় খবর আসা শুরু করল, টেন্ডুলকার তার ছেলের সাথে বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে! এটাই হচ্ছে কারণ টেন্ডুলকারের “টেন্ডুলকার” হওয়ার। আমাদের সাথে কয়েকজন ছিল, একই ক্লাবে খেলতাম, একই সাথে প্র্যাকটিস করতাম। কিন্তু তারা ছিল আমার চেয়ে যোজন যোজন ভাল খেলোয়াড়। কারণ কি? কারণ আমি ক্রিকেট খেলতাম বন্ধুরা খেলে বলে, আমি ক্রিকেট দেখতাম ছয়-চার-উইকেটের জন্য। ওরা ক্রিকেট খেলতো ভালো লাগে বলে, ওরা প্রতিটা বল দেখার চেষ্টা করতো। আমরা কয়েকজন মাঠে গিয়ে ব্যাটিং্যের জন্য লাইন দিতাম আর ওদের কয়েকজন ইচ্ছা করে ওভারের পর ওভার বল করে যেতো। আমরা এক-দু’ ঘন্টা খেলে ফিরে আসতাম, ওরা স্কুল বাদ দিয়ে ছোট-বড় সবার সাথে খেলেই যেতো, খেলেই যেতো। ক্রিকেটে আমি ওদের কাছে শিশুই রয়ে গেলাম। সুতরাং ওরা যদি জিজ্ঞাস করতো, “কেনো আমরা তামানের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার হবো?” উত্তর তৈরিই ছিল, ওরা আমার চেয়ে বেশি সময় ক্রিকেটে পরিশ্রম করেছে, তাই।
আমি গানবাজনা করেছিলাম কিছুদিন। ড্রাম বাজানো শিখেছিলাম এসএসসি পরীক্ষার পর। প্রথম কোচের কাছে তিনদিন যাওয়ার পর বেশ বড় একজনের কাছে গিয়েছিলাম। প্রথম কোচ দিনে ৪-৫ টা নোট(বিট) দিতো, ৫ মিনিট প্র্যাকটিস করতাম প্রতিটা নোট, তারপর বাসায় চলে যেতাম। দ্বিতীয় কোচের কাছে গেলাম। একটা ৪ বিটের নোট বাজাতে দিল। বললাম “পারি”। বললেন “বাজা”। বাজালাম। শুনে বললেন, “গুড তুই পারিস। এখন ১০০বার বাজা”। যারা গানবাজনা করেছো তারা এই বিষয়টা জানার কথা। পারিস ভাল কথা, ১০০০ বার পুনরাবৃত্তি কর। কোনো নোট ১০০০ বার না বাজিয়ে স্টেজে ওঠা বোকামি। তখন ভালো লাগে নি কথাটা, তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কথাটা খুবই সত্য। যারা কুরআনের হাফেজ হয়, তারা কি করে? তারা একবারে অনেকদূর যায় না। একটা নির্দিষ্ট অংশ রুটীন করে শেষ করে। যেই অংশ শেষ হয় সেই অংশ বারবার আবৃত্তি করে। পুরো কুরআনের হিফজ শেষ হলে প্রতি রমজানে ন্যূনতম একবার শোনে এবং শোনায়। যারা বছরে একবার হলেও পুরো কোরআন পাকের পুনরাবৃত্তি না করে তারা শিগগিরই ভুলে যায়। আমি নিজে দু’চারজন লোককে চিনি যারা এক সময় হাফেজ ছিল, এখন সেই সম্মান থেকে তারা বঞ্চিত।
নির্বাচনের সময়ে বাংলাদেশের সবাই কমবেশি স্লোগান-আড্ডা-বিতর্ক করে। কিন্ত বন্ধুমহলের একটা ছেলে সবসময় মিছিলের সামনে থাকে। কারণ কি? কারণ আমরা মিছিলে এসেছি “peer pressure” এর কারণে। সবাই করছে, বন্ধুরা মিলে আনন্দ তাই। কিন্তু সামনে যে ছেলেটা আছে সে গত ৫ বছরও রাজনীতি করে এসেছে। সে সুখে দুঃখে এই দলের বা প্রার্থীর সাথে ছিল। মোটকথা সে রাজনীতির পেছনে আমাদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে। সুতরাং সে যদি মিছিলের আগে প্রশ্ন করে, “কেনো আমি সবার আগে থাকবো যখন আমার বন্ধুরা আমার পেছনে থাকবে?” তার কাছেও উত্তর আছে, “কারণ আমি বেশি পরিশ্রম করেছি”
আমি কেন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগীতায় খারাপ ছিলাম? কারণ আমি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগীতা করেছি peer pressure এর কারণে। রাসেল ভাই আর ফাহিম আমাকে মোটামুটি ঠেলে-ধাক্কিয়ে প্রতিযোগীতা করাতো। রাসেল ভাই কনটেস্ট ছেড়ে দেয়ার পর আমার অংশগ্রহণ এ কারণে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে(গত এক বছরে হয়তো ৪-৫টা)। কিন্তু যারা ভাল? তাদের কোনো peer লাগে না। তারা নিজের আনন্দে প্রতিযোগীতা ও পরিশ্রম করে গিয়েছে। আমরা যখন একটা প্রতিযোগীতা করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, তারা তখন অমানুষিকভাবে না পারা সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যস্ত। যেগুলো কনটেস্টে শেষ হয় নি, সেগুলো করার জন্য জোরদার চেষ্টা চালাচ্ছে। এখানেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সুতরাং তারা যখন চিন্তা করবে “কেন আমি এই বছর ওয়ার্ল্ড ফাইনালে যাবো?” উত্তরটা তারা জানে। কারণ “আমরা নিখুঁত প্রোগ্রাম লিখতে পারি, কোনো পেনাল্টি খাই না”, কারো কারো উত্তর, “আমার দল সবচেয়ে ভালো জ্যামিতি পারে”, কারো দলের উত্তর, “আমাদের টীমওয়ার্ক বাংলাদেশের সেরা” ইত্যাদি।
এই লেখার মূল অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের খুব ভাল একজন প্রোগ্রামিং কনটেস্ট্যান্ট যারা এবার ঢাকা থেকে ওয়ার্ল্ড ফাইনালের অন্যতম দাবিদার। আমাকে কয়েকদিন আগে ফেসবুকে কনটেস্ট নিয়ে কোনো একটা পরামর্শ চেয়েছিল। তখন আমি এই উপদেশটা দিয়েছিলাম। “কেনো তোমার মনে হয় তোমাদের ওয়ার্ল্ড ফাইনালে যাওয়া উচিৎ?” এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিও না, নিজেকে করো, নিজেকে নিজে উত্তর দাও। যখন তুমি উত্তর দিতে যাবে তখনই তুমি বুঝবে তোমাদের শক্তি কোথায় এবং দুর্বলতা কোথায়। শক্তির জায়গাটা তখন আরো শক্তিশালী করবে, দুর্বলতাটার ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে। ফেদেরারের ফোরহ্যান্ড, মোহাম্মদ আলীর ফুটওয়ার্ক বা বেকহামের ফ্রিকিকের কথা চিন্তা করে দেখো। এগুলো ছিল, “আমি কেনো সেরা?” তাদের এই প্রশ্নের উত্তর।
অন্য সবার মতো আমারো দুর্বলতা আছে। বরং তোমাদের অনেকের চেয়ে আমার দুর্বলতার সংখ্যা এবং পরিধি অনেক বেশি। কিন্তু আমার স্বল্প বুদ্ধি থেকে আমি এই কাজটা নিয়মিত করি। যে কোনো স্বপ্ন দেখলেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, “কেনো আমি এটা পারবো?” তখনই উত্তর আসে “এটার জন্য, ওটার জন্য”। ব্যাস তখন শুধু এটা ওটা করা অথবা যদি এটা-ওটা করা আগ্রহ জাগানিয়া না হয় বা একেবারে অসম্ভব হয় তবে স্বপ্ন ভুলে যাওয়া। এখন আমি চাইলেই ম্যাডোনা বা আঞ্জোলিনা জোলি হতে পারবো না, এটূকু বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও তো অন্তত থাকতে হবে, তাই না! তারপরও হতাশ হই না তা বলা ঠিক না। কিন্তু চেষ্টা করি হতাশ কম হয়ে কাজ বেশি করতে। কাজ করলেই সফল হবো ব্যাপারটা তা না, কিন্তু কাজ করলে ব্যর্থ হবো না এটা নিশ্চিত 🙂
আমি এই বিষয়ে চাইলে একটা বই লেখতে পারি। কিন্তু আমার নিজের সাফল্যের ভান্ডার গত দু’তিন বৎসর ধরে একটু হালকা। গত বৎসর গুগোলে চাকরি পাওয়া আর ২০১৩ সালে এসিএম আইসিপিসির ঢাকা রিজিওনালের বিচারক প্যানেলে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া আর খুব বড় কিছু গত দু’বছরে হয় নি। সামনে বড় কিছু একটা করতে পারলে ইনশাআল্লাহ গুছিয়ে আরো কিছু উদাহরণ যোগ করে একটা বইয়ের মতো লিখে ফেলতে পারি। কিন্তু আমি একটু অলস, সুতরাং কেনো আমি বই লিখতে পারবো না এর উত্তরও আমার জানা 😉
পরিশেষঃ ব্যর্থ হওয়ার পরে “Why always me?” বলার চেয়ে সফল হতে চাওয়ার আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ “Why me?” বা “কেন আমি এই কাজটা পারবো যেটা অন্যরা পারছে না?” বাই দ্য ওয়ে, উত্তরটা যেনো আবার, “কারণ আমি খোদার প্রিয় বান্দা” বা “আমার ব্রেন ভালো” টাইপের কিছু না হয়! তোমাদের আবার বিশ্বাস কম, তোমরা পারোও ম্যান!